নিজেই ক্যান্সারে আক্রান্ত, তবুও থেমে নেই তার যুদ্ধ। অসুস্থ শরীর নিয়েই অন্যদের ক্যান্সার থেকে বাঁচাতে কাজ করে যাচ্ছেন ড. সৈয়দ হুমায়ুন কবির। নিজের কষ্টার্জিত আয়ের টাকায় তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন মানবতার এই সংগ্রাম।
কখনও অসহায় রোগীর ওষুধ কিনে দিচ্ছেন, কখনও আবার ক্যান্সার আক্রান্ত পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছেন এক নিঃস্বার্থ বন্ধুর মতো। শারীরিক অসুস্থতাকে ভুলে তিনি যেন অন্যদের জীবনে আলো জ্বালানোর কাজে নিবেদিত করেছেন নিজেকে।
২০১৫ সালে সৈয়দ হুমায়ুন কবিররের শরীরে ধরা পড়ে ‘লো-গ্রেড বি-সেল নন-হজকিন লিমফোমা’, এক ধরনের জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি ক্যান্সার। ক্যান্সারের চিকিৎসা নিতে গিয়ে তিনি কাছ থেকে দেখেন- ক্যান্সারের খরচ অনেক, অথচ বেশিরভাগ রোগীর পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই। চিকিৎসার খরচ এতটাই বেশি যে অনেকে মাঝপথে থেমে যান, কেউ কেউ ঋণের বোঝা টানতে টানতে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক পরিবার প্রিয়জনকে হারিয়ে জীবন যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে। এই বাস্তবতা তাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। নিজের কষ্ট আর অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝতে পারেন, অসহায় ক্যান্সার আক্রান্তদের জন্য কিছু করা দরকার। ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ, কেমোথেরাপি, শারীরিক অসুস্থতা, দুর্বলতা—এসবের মধ্য দিয়েই তিনি ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য গড়ে তোলেন ওয়ার্ল্ড ক্যান্সার সোসাইটি বাংলাদেশ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তিনি।
সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবী এই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি নিয়মিত ক্যান্সার সচেতনতা র্যালি, সেমিনার ও ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প আয়োজন করেন। এসব কর্মসূচিতে অসহায় রোগীরা বিনামূল্যে চিকিৎসা পরামর্শ, পরীক্ষা ও ওষুধ পান। গ্রাম থেকে যেসব ক্যান্সার রোগী চিকিৎসা নিতে ঢাকায় আসেন তাদের অ্যাম্বুলেন্স সেবা ও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাসহ চিকিৎসার খরচ বহন করে সংগঠনটি ।
তার মতে, ‘আমি জানি ক্যান্সারের ভয় কত গভীর। কিন্তু আমি এটাও জানি—সহানুভূতি আর ভালোবাসা সেই ভয় জয় করতে পারে।’
হুমায়ুন কবির শুধু চিকিৎসা সহায়তায় থেমে থাকেন না। অনেক সময় তিনি রোগীদের পরিবারের সদস্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করেন। কেউ সেলাই জানলে দেন সেলাই মেশিন, কেউ রিকশা চালাতে পারলে কিনে দেন রিকশাভ্যান, আবার কেউ দোকান দিতে চাইলে সহায়তা করেন পুঁজি দিয়ে। তার বিশ্বাস, একজন রোগী হারালেও তার পরিবার যেন বেঁচে থাকার সাহস না হারায়।
শুধু ক্যান্সার নয়, দেশের যেকোনো দুর্যোগেও তিনি পাশে থাকেন মানুষের। বন্যা, ঘূর্ণিঝড় কিংবা করোনা মহামারিতে তিনি ছুটে গেছেন ত্রাণ, ওষুধ ও খাবার নিয়ে। করোনা মহামারীর সময়, যখন মানুষ ঘর থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছিল, তখন সৈয়দ হুমায়ুন কবির নিজে পথে নেমে খাবার, ওষুধ এবং নেবুলাইজার, অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ করেন। তাঁর নিঃস্বার্থ এই উদ্যোগ হাজারো মানুষের জীবন রক্ষা করেছে।
পরিবেশ নিয়েও তাঁর আলাদা ভাবনা আছে। গত কয়েক বছরে তাঁর উদ্যোগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় লাগানো হয়েছে লক্ষাধিক গাছ। তার বিশ্বাস, সুস্থ পরিবেশ ছাড়া সুস্থ মানুষ তৈরি সম্ভব নয়। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও ভেজালমুক্ত খাবার নিয়ে জনসচেতনতায় নিয়েও কাজ করছেন সৈয়দ হুমায়ুন কবির। তাঁর বিশ্বাস, সুস্থ জীবনের মূল চাবিকাঠি হলো ভেজালমুক্ত ও নিরাপদ খাবার। এ লক্ষ্যেই তিনি বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও গ্রামীণ এলাকায় আয়োজন করেন খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক আলোচনা ও সেমিনার । সেখানে তিনি শেখান—কীভাবে কীটনাশকমুক্ত ফলন উৎপাদন করা যায়, কোন খাবারগুলো ক্যান্সার বা অন্যান্য জটিল রোগের ঝুঁকি বাড়ায়, আর কীভাবে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনে সুস্থ থাকা সম্ভব।
সংগঠনের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ড. সৈয়দ হুমায়ুন কবির চালু করেছেন বিনামূল্যে অক্সিজেন সিলিন্ডার ও মেডিকেল সহায়তা সেবা। জরুরি মুহূর্তে রোগীদের পাশে থাকতে রয়েছে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসও, যার মাধ্যমে অসুস্থ রোগীদের নিরাপদে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, সৈয়দ হুমায়ুন কবিরের এ সমস্ত কার্যক্রম সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত হয়। তার মানবিক কাজগুলোর পেছনে নেই কোনো বড় দাতা সংস্থা, নেই কোনো আর্থিক সহযোগিতা। তাঁর মতে, মানবসেবার জন্য ইচ্ছাশক্তিই সবচেয়ে বড় শক্তি।
সৈয়দ হুমায়ুন কবির বলেন, আমি নিজে ক্যান্সারে আক্রান্ত, শরীর অনেক সময় অসুস্থ থাকে। তবুও প্রতিদিন অফিসে যাই। আমার প্রতি মাসের বেতনের টাকা দিয়েই অন্যদের সাহায্য সহযোগিতা করি। যত দিন বাঁচব, অসহায় ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষদের জন্য কাজ করে যাব। আমি চাই বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক মানের ফ্রি ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ে তুলতে, যেখানে সব শ্রেণির মানুষ বিনামূল্যে চিকিৎসা পাবে।
এই প্রবল ইচ্ছা নিয়েই তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। অসুস্থতা শরীরকে ভেঙে দিতে চাইলেও, অন্য রোগীদের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আবার সোজা হয়ে দাঁড়ান।
Recent Comments